তৃতীয়বারের জন্য বাংলার মসনদে বসলেন মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। বুধবার রাজভবনে আনুষ্ঠানিক ভাবে রাজ্যপালের হাত থেকে সে দায়িত্ব ভার তুলে নেন। দায়িত্ব নিয়েই কোভিড মোকাবিলা যে 'ফার্স্ট প্রায়োরিটি' একথা নিজ মুখে জানিয়েছেন। ২৯৪ আসনের (যদিও নির্বাচন হয়েছে ২৯২ আসনে) ২১৩ টি তৃণমূল কংগ্রেসের, আর ৭৬ টি বিজেপির। যে বিজেপি দল ২০১৯-র লোকসভায় প্রায় অর্ধেকের কাছাকাছি আসন পেল, তাদের এমন ভরাডুবির কারণ কী? বিজেপি অবশ্য ২০১৬-র ৩ বিধায়কের স্থলে ৭৬ জন বিধায়ক নিয়ে প্রধান বিরোধীদল হিসেবে উঠে আসাকে কোনভাবেই লঘু ভাবে নিচ্ছে না। তবে বিজেপির ব্যর্থতার কয়েকটি চুলচেরা বিশ্লেষণ করাই যায়, যা বিজেপির অন্দরে ইতিমধ্যেই শুরু হয়েছে।
এবারের নির্বাচন ছিল বাঙালির অস্তিত্ব সংকটের লড়াই। বাঙালিত্ব বনাম বহিরাগত এই দুই মেরুকরণ এবারের নির্বাচনে বড় ভূমিকা তৈরি করেছে। বিজেপির কেন্দ্রীয় নেতৃত্ব বারবার তাঁদের জনসভায় দু-একটা বাংলা শব্দ উচ্চারণ করেছেন কিংবা বাংলা ভাষায় টুইট করেছেন, তারপরও বাঙালির হৃদয়ে স্থান করে নিতে পারেননি। এমনকি বিজেপির সর্বভারতীয় সভাপতি জে পি নাড্ডার মতো কেন্দ্রীয় নেতৃত্ব রবীন্দ্রনাথের মতো ব্যক্তিত্বের জন্মস্থান নিয়ে দেওয়া ভুল তথ্যে বাঙালি স্বভাবতই মুচকি হেসেছে। হয়তো মনে মনে ভেবেছে কাক হয়ে ময়ূর সাজার চেষ্টা করলে তেমনটাই হয়। প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী ভরা সভায় স্বীকার করেছেন যে তিনি বাংলা পারেন না, বাংলা শেখার চেষ্টা করছেন, একথা বাঙালি হৃদয়ে সাময়িক প্রভাব তৈরি করলেও দীর্ঘস্থায়ী হয়নি। বরং মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের বিজেপির কেন্দ্রীয় নেতৃত্বের উদ্দেশ্যে বারবার 'বহিরাগত' বলা, বাঙালি সেন্টিমেন্টে আঘাত করেছে বেশি। তাছাড়া পশ্চিমবঙ্গের প্রতি কেন্দ্রের 'বিমাতৃসুলভ' আচরণের কথা বহুকাল থেকে বলে আসছেন এ রাজ্যের বিভিন্ন রাজনৈতিক দল। বিজেপির উত্থানে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় বিভিন্ন সভায় এই কথা বারবার স্মরণ করিয়ে বাঙালির নরম মনে সহজেই জায়গা করে নিতে পেরেছেন। যা বিজেপির পক্ষে সম্ভব হয়নি। বিজেপি আয়ুষ্মান ভারতের কথা কিংবা প্রধানমন্ত্রী কিষাণ সম্মাননিধির কথা বলেছেন কিন্তু স্বাস্থ্যসাথী কিংবা কৃষক বন্ধুর মতো রাজ্যের প্রকল্পের মতো বিশ্বাসযোগ্যতা অর্জন করতে পারেনি। ফলে তৃণমূলের ভোটব্যাঙ্কে বিজেপি তেমন সাড়া ফেলতে পারেনি।
বিজেপি প্রথম থেকেই ধর্মীয় মেরুকরণের রাজনীতিকে পাখির চোখ করেছে। আসামে যা ফলপ্রসূ হয়েছে, বাংলায় তা হয়নি। বিজেপির আরএসএস সংগঠন তো স্বীকার করেইছে মুসলিমরা যেভাবে তৃণমূলকে ভোট দিয়েছে, হিন্দুরা বিজেপিকে ভোট দেয়নি। এই নির্বাচনে বাঙালিত্ব রক্ষার লড়াইয়ে হিন্দু-মুসলিম ভোট কাটাকাটিতে হিন্দুরা সেই পথ সহজে বেছে নেয়নি। বাঙালি হিন্দুত্ববাদ উত্তরপ্রদেশ কিংবা বিহার রাজস্থানের মতো এতটা এককাট্টা নয়। বাঙালিরা ভাত বিরিয়ানি দুটোতেই সমান স্বচ্ছন্দ। এই অখণ্ড বাঙালিয়ানা মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় যতটা নির্বাচনী প্রচারে তুলে ধরতে পেরেছেন, বিজেপি সফল হতে পারেনি। বরং তৃণমূলের দলছুট বিজেপি নেতাদের মুখে 'দুধেল গাই' কিংবা 'লুঙ্গিবাহিনী' শুনে বাঙালির অস্তিত্ব সংকটের প্রশ্ন তৈরি হয়েছে।
বিজেপির অন্দরে বেশ কয়েকদিন ধরে একটি প্রশ্ন ঘুরছে তৃণমূলের দলবদলুদের বিজেপি গ্রহণ করে লাভ হয়েছে নাকি ক্ষতি হয়েছে? বিজেপির হেভিওয়েট শুভেন্দু অধিকারী ছাড়া আর তেমন কেউ সাড়া ফেলতে পারেনি। তাহলে ২০১৯-এ লোকসভার পর জনমানসে তৃণমূলের তোষণনীতি কিংবা দুর্নীতির চিত্র একুশের নির্বাচনে ম্লান হয়ে গেছে। তৃণমূলের দলবদলুদের বিজেপিতে যোগদানের পর মানুষের কাছে বিজেপির 'স্বচ্ছ' ভাবমূর্তি অনেকটাই নষ্ট হয়েছে। এই নির্বাচনে সারদা নারদা তেমন প্রভাব ফেলতে পারেনি কিংবা বেকারত্ব। বরং বিজেপির তৃণমূলের দলছুটদের সাদরে অভ্যর্থনায় সাধারণ জনমানসে বিরূপ প্রতিক্রিয়া তৈরি হয়েছে।