জীবনে ব্যর্থতা বেশি আসে, সফলতা কয়েকটা! বাকি সবই গড়পড়তা; কুয়াশা
'প্রচেষ্টা'ই হল সফলতার মূল মন্ত্র! পরিদর্শকের সঙ্গে খোলমেলা আড্ডায় "দেবীনা" কুয়াশা
(Tollywood Actress Kuyasha) তথাকথিত ভাবে অপ্রিয় খল চরিত্রে অভিনয় করেও, হয়ে উঠেছিলেন সকলের প্রিয়। তাঁর অভিনীত 'ফেলনা' ধারাবাহিকের "অনিতা" হোক, কিংবা 'আয় তবে সহচরী'র "দেবীনা", নেতিবাচক চরিত্র হলেও, অভিনয় দক্ষতা দিয়েই হয়ে ওঠেন স্বয়ং মমতা শঙ্করের স্নেহধন্যা। পছন্দের মানুষ থেকে স্মরণীয় ঘটনা, জীবনের নানা মুহূর্ত পরিদর্শকের সঙ্গে ভাগ করে নিলেন 'বাংলা মিডিয়াম' এর "পামেলা", ওরফে কুয়াশা।
১) কেমন আছো? এই মুহূর্তে শুটিং ছাড়া জীবনকে আর কীভাবে উপভোগ করছ?
- এক কথায় বলতে চাই, অনেক দিন পর সত্যিই ভালো আছি। জীবনে একটু শান্তি ও স্থিরতা এসেছে। এতদিন নিজেই নিজেকে প্রেরণা যোগাতাম, উদ্যমী হতাম। কিন্তু ভালো থাকার জন্য, এগিয়ে যাওয়ার জন্য হয়ত এরকম একজন মানুষ জীবনে ভীষণ প্রয়োজনীয়, যিনি তোমার ওপর বিশ্বাস রাখবেন, এবং বলবেন "এভরিথিং উইল বি অলরাইট"। আমার জীবনেও এমন মানুষের উপস্থিতি ঘটেছে, তাই আমি ভালো আছি। শুটিং থাকুক বা থাকুক, আমি খুব শৃঙ্খলা-প্রেমী মানুষ।সঠিক সময়ে ঘুম থেকে ওঠা, প্রাতঃরাশ থেকে শুরু করে রাতের খাবার তৈরি, সবটা নিজের হাতে করি। ডায়েট আমাকে করতেই হয়। তবে সেই খাবারও যাতে সুস্বাদু হয় তেমন "কুকিং টেকনিক" আবিষ্কার করা, বই পড়া, সিনেমা দেখা এবং শরীর চর্চাটাও আমি খুব মন দিয়ে করি। নিজেকে আরও, আরও এবং আরও "চ্যালেঞ্জিং" কাজের জন্য তৈরী করি, রোজ।
২) যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ইতিহাস নিয়ে তোমার পড়াশোনার পর অভিনয় জীবনে আসার পেছনে পারিবারিক সমর্থন কেমন ছিল?
- পরিবারের তরফ থেকে কোনও রকমের কোনও সমর্থন ছিল না। সবটাই আমার জেদ। আমি যে সত্যি সত্যিই অভিনেত্রী হতে পারব, সেটা আমার একারই বিশ্বাস ছিল। পরিবারের কোনও যোগসূত্র ছিল না আমার ইচ্ছের সঙ্গে।
৩) ইতিহাসের ছাত্রী তুমি, সঙ্গে অভিনেত্রী। এমন কোনও প্রিয় ঐতিহাসিক চরিত্র আছেন, যাঁকে তুমি পর্দায় ফুটিয়ে তুলতে চাও?
- সাবিত্রী বাই ফুলে, একাধারে কবি ও সমাজ সংস্কারক। ব্রিটিশ ভারতে বিবাহের পরে পড়াশুনা শিখে যে এত কিছু করা যায়, আমি ভাবতেই পারি না। কী নিয়ে কাজ করেননি উনি! বর্ণবৈষম্য, লিঙ্গবৈষম্য, নারীশিক্ষা, শিশুহত্যা, সতীদাহপ্রথার মত সকল কু-প্রথার বিরুদ্ধে সোচ্চার হয়েছিলেন। মনে রাখতে হবে উনি যখন সমাজের দুর্নীতির বিরুদ্ধে সরব হন, সেই সময়টা ১৮৫০। স্বাধীনতারও প্রায় একশ বছর আগে। কতটা মানসিক জোর থাকলে সেই সময় দাঁড়িয়ে, একজন নারী হয়ে এমন 'অসাধ্য' সাধন করা যায়! তাই ভাবি মাঝেমধ্যে, এই সময় দাঁড়িয়েও নারীদের সামাজিক অবস্থার যে উন্নতি হয়েছে, সে কথা বলা যায় না! তাই সাবিত্রী বাই ফুলের মত একজন 'আলোর দিশারী'র দরকার পড়ে আমাদের সমাজে। এমনকি তাঁর মৃত্যুটাও 'বীর' এর মত। ওঁর চরিত্রটি কখনও নিজের হাতে তৈরী করতে চাই, খুব যত্ন সহকারে।
৪) প্রায় দশ বছর হয়ে গেল ইন্ড্রাস্ট্রিতে। কেমন ছিল শুরুর দিকে যাত্রা?
- দশটা দরজায় কড়া নাড়লে দুটো খুলতে পারে, সেই দুটো জায়গায় নিজেকে প্রমান করতে পারলে তবেই পরের তিনটে দরজা খুলবে। আর আমি মানুষ, ভুল তো হবেই। স্বয়ং শাহরুখ খানের বলা একটি দর্শন আমি খুব মানি। জীবনে তোমার ব্যর্থতাই বেশি আসবে। সাফল্য তো হাতে গুনে কয়েকটা, বাকি সবই গড়পড়তা। প্রথম পাঁচ বছর তো সঠিক এবং নিরাপদ জায়গা খুঁজতে খুঁজতেই কেটে গেছে, আর শিখতে শিখতে। যদিও এখনও শিখছি।
৫) 'ফেলনা', 'আয় তবে সহচরী', 'বাংলা মিডিয়াম', পর পর খল চরিত্রে অভিনয়! টাইপ-কাস্ট হয়ে যাওয়ার ভয় কাজ করে?
- টাইপ-কাস্ট হয়ে যাবে ভেবে ভয় পাই না। কারণ জানি অভিনয় আমার জীবিকা, আমার উপার্জনের আধার। তবে ইতিমধ্যে আমি অনেক জায়গায় বেশ জোর দিয়ে আর্জি জানিয়েছি যে 'পসিটিভ' চরিত্র করতে চাই। তার মধ্যে হয়ত কিছু হলেও হতে পারে। খুব তাড়াতাড়িই, দেখা যাক।
৬) 'ফেলনা'র আগে তোমায় মূলত ইতিবাচক চরিত্রেই দেখা যেত। সেখান থেকে নেতিবাচক চরিত্রে আসা, এবং একইভাবে সেখানেও সফলতা লাভ। কীভাবে তৈরি করেছিলে নিজেকে?
- কোনও চরিত্র করার আগে যদি আমি মনে করি তিনি 'খল', তাহলে সেটি সেই চরিত্রের প্রতি অবিচার করা। কারণ প্রত্যেক মানুষেরই নেতিবাচক হওয়ার পেছনে পারিপার্শ্বিকতার প্রভাব কাজ করে। 'ফেলনা' তে অনিতার ক্ষেত্রেও ছিল, 'আয় তবে সহচরী' তে দেবীনার ক্ষেত্রেও তাই। সন্তান হওয়ার পর অনিতা স্বামীর বঞ্চনার সঙ্গে পারিপার্শ্বিক বিভিন্ন প্রতিকূলতার সম্মুখীন হয়। তাই 'ফেলনা' র প্রতি তাঁর সকল ক্ষোভ উগড়ে দেয়। দেবীনা চরিত্রটির ক্ষেত্রেও তাই। তাঁর নেতিবাচক হওয়ার পেছনে রয়েছে পারিবারিক প্রভাব। ছোট থেকে তাঁর বাবা মায়ের মধ্যে অসহিষ্ণুতা দেখে এসছে, মতবিরোধ দেখে এসছে। যাঁরা তাঁদের সন্তানকে পর্যন্ত গুরুত্ব দেননি। একজন শিশুর ওপর অভিভাবকের মধ্যবর্তী কলহ বা অবহেলা যে কী ভয়ঙ্কর প্রভাব ফেলে, তা বলতে বাকি রাখে না। দেবীনার, দেবীনা হয়ে ওঠার পেছনেও ছিল এমন প্রতিকূল পরিস্থিতি। এখানেই খারাপ ভালোর সংজ্ঞাটা আমার কাছে কেমন এলোমেলো হয়ে যায়। মনে হয় সবটাই আপেক্ষিক। যিনি তথাকথিত ভাবে খারাপ হয়ে উঠছেন, তাঁকে যাচাই করার আমিই বা কে! আর সমাজই বা কে! এভাবেই আমার চরিত্র গুলির নানান মনস্তাত্বিক পটভূমি বিচার করে রসদ পাই আমি। সেইভাবেই তৈরি করি নিজেকে।
৭) এখন তুমি 'বাংলা মিডিয়াম' এর পামেলা, যিনি আধুনিকতা মানে ইংরাজী চর্চাকেই মূল মন্ত্র ভাবেন। ইংরাজী এবং বাংলা মাধ্যমের দ্বৈরথে, কুয়াশা কার পক্ষে?
- 'আধুনিকতা' মানে কখনওই তো কোনও নির্দিষ্ট সংস্কৃতি বা 'কালচার' হতে পারে না। আধুনিকতা হল সময়ের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে এগিয়ে চলার মানসিকতা। যা অপর মানুষকে কোনওভাবেই বিচার করে না। যিনি যেমন, তাঁকে তাঁর মতন করে গ্রহণ করতে জানে। কোনও একটি সংস্কৃতিকে উন্নত বা সমৃদ্ধ দেখানোর জন্য অন্য সংস্কৃতিকে নিচু করারও কোনো দরকার হয় না। বরং যদি তা করা হয়, সেটাই হবে তবে অপসংস্কৃতি।
৮) তোমার অভিনীত খল চরিত্রগুলি, কুয়াশার কাছে ব্যাক্তিগতভাবে কি সত্যিই খল, নাকি আশীর্বাদ?
- ভালো বা খারাপ বিষয়গুলি বেশ আপেক্ষিক। তাই কেউ কেন তথাকথিত ভাবে 'খারাপ' আচরণ করেন, তাঁর পারিপার্শ্বিকতা নিয়ে আমি তখন ভাবি। উপলব্ধি করার চেষ্টা করি। আমার অভিনীত চরিত্রগুলির ক্ষেত্রেও তাই হয়েছে। অ-কারণে তাঁরা খারাপ হননি। খল চরিত্রে অভিনয় করাও অন্যতম 'চ্যালেঞ্জিং'। এই সকল চরিত্রের খল হওয়ার পেছনে বিভিন্ন মনস্তাত্বিক দিক থাকে। সেই ধরনের চরিত্র ফুটিয়ে তুলতে পেরে যে সকলের ভালোবাসা পেয়েছি, তা সত্যিই আমায় আনন্দ দেয় এবং পরবর্তী কাজের জন্য উদ্যমী করে তোলে।
৯) রুপোলি পর্দার এমন কোনও চরিত্র আছে, যে চরিত্রে সুযোগ পেলে তুমিও অভিনয় করতে চাও?
- রুপোলি পর্দার এমন একটা নয়, বেশ অনেক চরিত্র আছে, যেগুলি আমি করতে চাই। তার তালিকা অনেক লম্বা।
১০) এখনও এক বিশাল সংখ্যক দর্শক আছেন, যাঁরা ভাবেন অভিনীত চরিত্রই ব্যাক্তিগত জীবনের প্রতিফলন। কখনও কোনও অনুষ্ঠানে কুয়াশাকে, "দেবিনা" অথবা "পামেলা"র সঙ্গে কেউ এক করে ফেলে ভুল করেছেন? কীভাবে অতিক্রম করেছ সেই মুহূর্ত?
- 'আয় তবে সহচরী' করার সময় সামাজিক মাধ্যমে প্রবল কটু কথা শুনলেও, যাঁরা আমায় সামনে দেখে চিনতে পারেন, আমার সঙ্গে কথা বলার পর তাঁরা খুব অবাক হয়ে যান। তাঁদের কথায়, আমি নাকি স্ক্রিনের থেকে অনেক আলাদা! একেবারে একশো আশি ডিগ্রী! সামনাসামনি ভালো মন্তব্যই শুনেছি, আশীর্বাদ পেয়েছি, ভালোবাসা পেয়েছি। সেরকম দুর্ব্যবহার এর সম্মুখীন হইনি এখনও পর্যন্ত।
১১) অভিনয় জীবনে ঘটা বা অনুগামীদের থেকে পাওয়া এমন কোনও স্মরণীয় মুহূর্ত আছে যা পরিদর্শকের সঙ্গে ভাগ করে নিতে চাও?
-
আয় তবে সহচরী শেষ হওয়ার পর আমার এক বিশেষ বান্ধবীর সঙ্গে একবার কলেজস্ট্রিটের একটি দোকানে যাই। সেখানেই এক দল মহিলা আমাকে ঘিরে ধরেন। বুকে টেনে নিয়ে আমার অভিনয়ের প্রশংসা করতে থাকেন। এমনকী একটি দোকান থেকে আমায় মিষ্টিও খাওয়ানোর জন্য তাঁরা ব্যস্ত হয়ে পড়েন। আমায় নিয়ে তাঁদের ব্যস্ত হয়ে পড়তে দেখে অপরদিকে আমার বান্ধবী একটু অসন্তুষ্টই হয়ে পড়ে। কারণ দীর্ঘদিন দিল্লি থাকার দরুন অনেকদিন পর সুযোগ পেয়েছিল আমার সঙ্গে দিনটিকে উপভোগ করার। তাই জন্য সেদিন আমায় নিয়ে ভাগাভাগি তাঁর একেবারেই পছন্দ হচ্ছিল না। যদিও বলা বাহুল্য সেদিন আমায় নিয়ে করা মাতামাতি আমার ভালোই লেগেছিল।
আরেকটি ঘটনা না বললেই নয় ২০২২ সালে 'কলকাতা ফিল্ম ফেস্টিভ্যাল' এ, অন্যান্য গন্য মান্য শিল্পীদের সঙ্গে আমিও আমন্ত্রিত হয়েছিলাম। অনুষ্ঠানের শেষে মাননীয়া মুখ্যমন্ত্রী স্থান ত্যাগ করার পরেই, সবাই নজরুল মঞ্চ থেকে তড়িঘড়ি বাইরে বেরোনোর চেষ্টা করতে থাকে। আমিও সেই ভিড়ের অংশ ছিলাম। হঠাৎ বুঝতে পারি, আমার হাতটা পেছন থেকে কেউ টানছেন। পেছন ফিরতেই দেখি মাননীয়া মমতা শংকর আমার হাত ধরে দাঁড়িয়ে আছেন। সেই ভিড়ের মধ্যেই আমাকে কাছে টেনে নিয়ে খুব আদরের সঙ্গে জানালেন আমার অভিনয়ের তিনি নিয়মিত দর্শক। 'ফেলনা', দেখেছেন এবং 'আয় তবে সহচরী'ও নিয়ম করে দেখেন। আমার তখন মনে হচ্ছিল, আমি যেন স্বপ্ন দেখছি! যিনি সত্যজিৎ রায়, মৃণাল সেনের মতো যুগান্তকারী পরিচালকদের নায়িকা এবং জাতীয় পুরস্কার প্রাপ্ত একজন অভিনেত্রী, তিনি আমার কাজ দেখে প্রশংসা করছেন! ওঁর ছোঁয়া, আমার কাছে জিয়নকাঠির ছোঁয়ার মতই অমূল্য হয়ে উঠেছিল।
১২) অবসর সময় কীভাবে যাপন করো?
- অবসর খুব একটা রাখি না জীবনে। সব সময়ই কিছু না কিছু 'প্রডাক্টিভ' করার চেষ্টা করি। তবে মাঝে মধ্যে আমি বিভিন্ন 'সোলো ট্রিপ' এ বেরিয়ে পড়ি। গত দুমাসে চল্লিশ দিন হিমাচল প্রদেশে এবং তেইশ দিন গোয়াতে থেকে এসেছি। এগুলিকে আমি আমার 'সেল্ফ ওয়ার্কশপ' এর অঙ্গ বলেই মনে করি।
১৩) পর্দার বাইরে 'স্টারডম' কেমন উপভোগ করো?
- পরিচিতি আমার কাজের একটি অঙ্গ মাত্র। তবে 'স্টার' আমি নই। কিন্তু হ্যাঁ, অবশ্যই মানুষ যখন ভালো বলেন, ভালো লাগে।
১৪)আগামী প্রজন্মের শিল্পীদের জন্য তোমার ব্যাক্তিগত অভিজ্ঞতা থেকে কী কী পরামর্শ দিতে চাও?
- আগামী প্রজন্মের জন্য বলতে চাই, স্বপ্ন দেখো এবং সেই স্বপ্নে বিশ্বাস করো। স্বপ্ন না দেখলে তা সত্যি হবে কী করে! তবে এটাও মনে রাখতে হবে, সেই স্বপ্ন বাস্তব করতে গেলে অনেক পরিশ্রম করতে হবে। অনেক ত্যাগ স্বীকার করতে হবে, একেবারে নিজের জেদ নিয়ে অটল থাকতে হবে।
১৫) তোমার কাছে সফলতার মন্ত্র কী?
- প্রচেষ্টা।