উচ্চতা কম বলে, প্রচুর সুযোগ হাতছাড়া হয়েছে; প্রীতম দাস
চাকরি এবং অভিনয়ের মাঝে, বেছে নিয়েছিলেন অভিনয়কে। অভিনেতা প্রীতম দাসের অজানা কাহিনীর সাক্ষী হল পরিদর্শক
ঐতিহাসিক চরিত্র হোক কিংবা আধুনিক, তাঁর সাবলীল অভিনয় মন জয় করে নিয়েছে বাঙালি দর্শকের। তাঁর অভিনীত চরিত্রের নামে, নামকরণও হয়েছে নবজাতকের। তবুও থেকে গেছে অভিনেতা প্রীতম দাসের জীবনে নানান ক্ষোভ। ভাগ করে নিলেন পরিদর্শকের সঙ্গে।
১) কেমন আছো? এই মুহূর্তে শুটিং ছাড়া আর কীভাবে উপভোগ করছ জীবন?
- 'ভালো আছি' বললে ভুল বলা হবে, কারণ 'ভালো আছি' তাঁরাই বলতে পারেন, যাঁদের জীবনে আর কোনও চাহিদা নেই। কিন্তু ব্যাপারটা হল, আমার জীবনে এখনও অনেক চাহিদা আছে। এখন অনেক কাজ করার ইচ্ছা আছে। তাই আমি ভালো নেই। নতুন কাজ করার ইচ্ছে আমাকে তাড়া করে বেড়ায়। আর, আমি শুটিং ছাড়া গিটার বাজাই, বই পড়ি, নিজেকে গ্রুম করি, বাড়িতে মা বাবা, নিজের বন্ধু-বান্ধবদের যতটা পারি সময় দি, আর তাছাড়া যাঁরা আমার থেকে সময় চান, যাঁরা আমার কাছের মানুষ, তাঁদেরকে আমি সময় দিতে ভালোবাসি। আমার সবচেয়ে পছন্দের কাজ হল ‘ঘুরে বেড়ানো‘, তাই আমি ঘুরে বেড়াই। এবার এক্ষুনি যদি আমায় জিজ্ঞেস করা হয়, আমার জীবনের প্রেম বা ভালো লাগার মানুষ সম্পর্কে, তাই আগে থেকেই বলে রাখি, আমার জীবনের প্রেম ইজ ইকুয়াল টু 'Rest in Prem!' কারন আমাকে বোঝার মানুষ এই পৃথিবীতে সত্যি খুব কম। এটা যদিও শুধুমাত্র আমারই মনে হয় (হাসি)।
২) এত কম বয়সে পৌরাণিক থেকে আধুনিক, সকল ধরনের চরিত্রেই তুমি সাবলীল। অভিনয়ে আসা কীভাবে?
- চরিত্রকে নিজের ভাবতে শুরু করলেই মানুষ আপনা থেকেই সাবলীল হয়ে উঠবেন। ক্লাস ফাইভে স্কুলের গ্রুপ থিয়েটার দিয়ে শুরু, ক্লাস টেন পর্যন্ত নাটক করার পর একবারে কলেজ লাইফের সেকেন্ড ইয়ারে গিয়ে আবার আমি নাটক করা শুরু করি। সামাজিক মাধ্যমে অভিনয় জগতের সঙ্গে যুক্ত ব্যাক্তিদের সঙ্গে পরিচয় হতে থাকে। অভিনয় করার ইচ্ছে থেকে বিভিন্ন স্টুডিওয় ছবি পাঠাতে থাকি। এমনই একদিন সামাজিক মাধ্যমে একজন আমায় বলেন, অভিনয় করতে চাইলে তাঁকে যেন আমার ফোন নম্বর দি। এই সূত্র ধরেই জীবনের প্রথম ব্রেনোলিয়ার বিজ্ঞাপনে আমার ডাক পাওয়া। কিন্তু কিছুদিনের মধ্যে বুঝে যাই, অভিনয় জগতে কাজ পাওয়া সহজ হলেও, টিকে থাকা কঠিন হবে। সেই শুরু হল আমার লড়াই। সবচেয়ে বেশি মানসিক দ্বন্দ্বে ভুগতে হয়, কলেজ শেষ করার পর যখন চাকরি আর অভিনয়ের যেকোনও একটিকে বাছতে হয়। আমি অভিনয়কে বাছি। আর তারপর থেকেই আমার লড়াই আরও কঠিন হতে শুরু করে, বলা বাহুল্য, তার সঙ্গে দোসর হয় আগাম জীবনের অনিশ্চয়তা।
৩) বাড়িতে কেউ অভিনয়ের সঙ্গে যুক্ত? পরিবার থেকে কেমন সমর্থন পেয়েছিলে?
- আমার বাড়িতে অভিনয় জগতের ধারে কাছে কেউ ছিলেন না। সবচেয়ে বড় কথা, আমার বাবা চাকুরীজীবী। তাই সবাই চাকরি করাকেই বেশি প্রাধান্য দিয়েছেন। প্রথমে একটু আমার অভিনয় জগতে আসা নিয়ে মান-অভিমান হলেও, পরে পরিবারের সকলে আমার দিকটা বোঝেন, এবং সমর্থন করেন।
৪) 'রাণী রাসমণি'হোক বা 'ভক্তের ভগবান শ্রী কৃষ্ণ', দুটিই ঐতিহাসিক এবং পৌরাণিক গল্প অবলম্বনে, যা আধুনিক যুগ থেকে অনেক আলাদা। সেরকম দুটি উপস্থাপনায় অভিনয় করতে গিয়ে, তোমায় কী কী অনুসরণ করতে হয়েছে শিল্পী হিসেবে?
- "ভক্তের ভগবান শ্রীকৃষ্ণ"তে আমার অভিনয় যে দর্শকের এখনও মনে আছে, এটা আমার জীবনের অন্যতম বড় প্রাপ্তি। কারণ খুব ছোট একটি চরিত্রে অভিনয় করেছিলাম। আসলে তখনও এই বাংলা ইন্ড্রাস্ট্রির একজন, সেইভাবে হয়ে উঠিনি। থিয়েটার করতাম বলে সংলাপের স্ক্যানিং করতে আমার অসুবিধা হত না। তবে টেকনিক্যাল বিষয়গুলো আমার খুব গুলিয়ে যেত। কিন্তু 'রাণী রাসমণি' চলাকালীন এই 'মাধব' চরিত্রটিকে তৈরি করার পুরো অবদান আমি দেব, আমাদের পরিচালক রাজেনদাকে (রাজেন্দ্রপ্রসাদ দাস)। উনি হাতে ধরে আমাকে শাসন করে, বুঝিয়ে, অভিনয় করিয়ে নিয়েছিলেন।
৫) অনেক ধরনের চরিত্রে ইতিমধ্যে অভিনয় করেছ। রুপোলি পর্দার এমন কোনও চরিত্র আছে, যেটি সুযোগ পেলে তুমি করতে চাও?
- আমি সমস্তরকম একঘেয়ে চরিত্র থেকে বেরিয়ে এসে, নতুন ধরনের চরিত্রই করতে চাই।
৬) গত বছর ওয়েব সিরিজেও অভিষেক ঘটেছে তোমার। 'ভাগাড়' এর অনির্বাণের সঙ্গে নিজের মিল খুঁজে পাও? বাস্তবে কখনও কোনও অন্যায়ের বিরুদ্ধে সরব হয়েছ?
- এই প্রসঙ্গে আগে বলে রাখি, এই বছরও আমার অভিনীত একটি নতুন ওয়েব সিরিজ আসছে! নামটা এই সাক্ষাৎকারেই আমি উল্লেখ করে দিয়েছি (হাসি)! শুধু একটু কষ্ট করে খুঁজে বের করে নিতে হবে। 'অনির্বাণ' আর প্রীতমের মধ্যে একটা ছোট্ট মিল আছে, দুজনেই দিনের শেষে সত্যি কথা বলতে পছন্দ করে। সেটা যতই খারাপ হোক না কেন! কারণ একটা মিথ্যেকে ঢাকতে গিয়ে অনেক মিথ্যে বলতে হয়, কিন্তু একটা সত্যি বলে দিলে হয়ত সাময়িকভাবে খারাপ লাগতে পারে, কিন্তু মন থেকে নিজের প্রতি সৎ থাকা যায়। অন্যায়ের বিরুদ্ধে সরব হতে গিয়েই তো নিজের কত কাছের মানুষকে হারিয়ে ফেললাম।
৭) তোমায় বরাবরই বেশ শান্ত-শিষ্ট 'গুড বয়' ইমেজে দেখা যায়। ছোটবেলায় কেমন ছিলে? কোনও মজার ঘটনা ভাগ করে নিতে চাও?
- অভিনেতা তো, সারাদিন অভিনয় করি (লাজুক হাসি)। যাঁরা আমার কাছের মানুষ, তাঁরা খুব ভালো করে জানেন আমি কতটা শান্ত-শিষ্ট আর 'গুড বয়' প্রকৃতির (হাসি)। অবশ্য যাঁরা আমার জীবন থেকে চলে গেছেন, তাঁদের ব্যাপার আলাদা। তাঁদের মধ্যে আমায় নিয়ে খারাপ মনোভাবই থেকে গেছে। আর ছোটবেলার প্রসঙ্গে বলি, আমি ছোটবেলায় একদমই শান্ত ছিলাম না। খুব দুষ্টু প্রকৃতির ছিলাম, প্রচন্ডরকম চঞ্চল। যেহেতু খুব ছোট্ট খাটো মানুষ ছিলাম, তাই যে কেউ আমায় দেখলে খুব তাচ্ছিল্য করত। সেটাই আমার রাগের কারণ হয়ে দাঁড়াত। আর তারপরেই শুরু হত আমার প্রতিবাদ (হাসি)। আমার জামার কলার ধরেছিল বলে আমি এক বন্ধুর নাক ফাটিয়ে দিয়েছিলাম। এখন তার কাছ থেকে আমি ক্ষমা চেয়ে নিচ্ছি।
৮) 'রাণী রাসমণি' তে মাধব, এবং 'মেয়েদের ব্রতকথা' এর মাধব, একই নামের দুই চরিত্র, কিন্তু তফাৎ আকাশ পাতাল। একটি ইতিবাচক চরিত্র, একটি নেতিবাচক। একই নামের, বিপরীতধর্মী চরিত্রের অভিনয় কতটা 'চ্যালেঞ্জিং'?
- এই "মাধব" নামটি এই কারণেই আমার কাছে সত্যি খুব প্রিয় যে, এই নাম নিয়ে আমি ইতিবাচক চরিত্রও করেছি, আবার নেতিবাচক চরিত্রও করছি। "মাধব" নামটি যেহেতু ভগবান শ্রী কৃষ্ণের আর এক নাম, তাই বোধ হয় তিনিই আমার মধ্যে বিরাজ করেন। মনে হয়, তিনিই আমাকে দিয়ে করিয়ে নেন সবকিছু। 'চ্যালেঞ্জিং' এর বিষয় হল, একটি চরিত্রকে প্রথম কয়েকদিন তৈরী করা। একবার দর্শকের মনে গেঁথে গেলে 'গো উইথ দ্য ফ্লো'।
৯)বেশ অনেক বছরই ইন্ড্রাস্ট্রিতে হয়েছে তোমার, এখন বেশ শক্তিশালী একটা জমিও তৈরি করেছ নিজের। কতটা কঠিন ছিল তোমার এই সফর?
- কীসের আর শক্তিশালী! এখনও অভিনয় জগতে মানুষ অভিনয় না দেখে উচ্চতা নিয়ে কথা বলেন। আমি প্রচুর চরিত্রে শুধুমাত্র উচ্চতা কম বলে বাতিল হয়ে গেছি। আমি এখনও বুঝতে পারি না, উচ্চতার সঙ্গে অভিনয়ের কী সম্পর্ক। উচ্চতা বেশি হলে কি অভিনয় ভালো করা যায়? এই প্রশ্নের উত্তরটা কি কেউ আমায় দেবে! আর কতটা কঠিন বলতে গেলে, দু বেলা দুটো পাঁচ টাকার ম্যাগি খেয়ে কাটানো, এমনটাই ছিল আমার এই সফর।
১০) নতুন হিসেবে এমন কোনও অপ্রীতিকর পরিস্থিতির সম্মুখীন হতে হয়েছে, যা থেকে পরবর্তীতে শিক্ষা নিয়ে এগিয়েছ? এখনকার নতুন শিল্পীদের উদ্যেশ্যে কী পরামর্শ দিতে চাও?
- কিছুদিন আগেই এক টিভিসির কাজের জন্য যাই, এক নামকরা কাস্টিং এজেন্সির মারফত। আমায় আমার চরিত্র সম্পর্কে বলা হয়, এবং বলা বাহুল্য সেই চরিত্রের প্রচুর সংলাপ ছিল। সারাদিন ধরে সংলাপ মুখস্ত করে গেলেও, আমার ডাক আসে না। দীর্ঘ সময় পর জানতে পারি, আমার সংলাপ বলছেন অন্য কেউ। জানতে পারি, তিনি পরিচালকের পরিচিত। সেই মুহূর্তে আমার চরম অর্থের প্রয়োজন ছিল, তবুও ভেবে চিন্তে, ঠান্ডা মাথায় সিদ্ধান্ত নি, নিজেকে মূল্যহীন করে তুলব না। বেরিয়ে আসি সেখান থেকে। নতুন, তথা 'অচেনা' হয়েও আমার এমন আচরণে অনেক শোরগোল সৃষ্টি হয়, এমনকি কাস্টিং এজেন্সির মালিক ব্যাক্তিগত ভাবে জানান যে আমি আমার প্রাপ্য টাকা পেয়ে যাব। কিন্তু আমি আমার উত্তরেই অনড় থাকি। আমি তাঁদের জানাই, "অভিনয় আমি ভালোবেসেই করি, তাই অভিনয়ের জন্য টাকা পাই। টাকা পাই বলে অভিনয় করতে আসিনি।" তাই নতুনদের উদ্যেশ্যে বলার, মাথা সবসময় ঠান্ডা রেখো। তাড়াহুড়োয় নেওয়া সিদ্ধান্ত অনেক সময় বিপথে নিয়ে যেতে পারে।
১১) ছোটবেলা থেকে অভিনয়ের প্রতি ঝোঁক ছিল? অভিনেতা ছাড়া আর কী হওয়ার ইচ্ছে ছিল?
- শুরুতেই বলেছি ক্লাস ফাইভ থেকে আমি নাটক করি। অভিনেতা হওয়ার ইচ্ছা ছিল কিনা জানি না, তবে অভিনয় করতে ভালবাসতাম। অভিনেতা না হলে হয়তো এখন কোন কোম্পানিতে কম্পিউটারের সামনে মুখ গুঁজে বসে থাকতাম।
১২) নিজের অভিনীত কোন চরিত্রের সঙ্গে বাস্তবের প্রীতমের মিল পাও?
- অভিনয় জগতে গল্পের গরু গাছে ওঠে, তার সঙ্গে বাস্তবের কোন মিল নেই।
১৩) একজন শিল্পী হওয়ার জন্য কীভাবে প্রস্তুতি নিতে হবে বলে তুমি মনে করো?
- নিজের শিল্পে মন দাও। মনোযোগ সহকারে শিল্পটা করো।আর নিজের প্রতি কনফিডেন্স নিয়ে আসো।
১৪) অভিনয় ছাড়া, অবসর সময় কীভাবে যাপন করো?
- নিজেকে গ্রুম করে।
১৫) অভিনয় জীবনে বা অনুগামীদের থেকে পাওয়া এমন কোনও স্মরণীয় মুহূর্ত আছে, যা ভাগ করে নিতে চাও পরিদর্শকের সঙ্গে?
- আমার একজন অনুগামী, আমার একটি পোট্রেট এঁকে আমাকে দিয়েছিলেন। ছেলেটির নাম রৌনক ভট্টাচার্য। খুব ভালো ছবি আঁকেন এবং ছেলেটিও খুব ভালো। এছাড়া আরেকটি ঘটনা খুব মনে পড়ে, আমায় একদিন ফেসবুকে একজন মেসেজ করে জানালেন যে, তাঁর একজন পরিচিতর একটি ছেলে হয়েছে। তাঁরা সেই তাঁদের সন্তানের নাম রেখেছেন "ইরাবতীর চুপকথা"র আমার চরিত্রের নাম অনুযায়ী "ডাম্পু"! এবং তাঁদের এই নাম রাখার কারণ হল, তাঁদের সন্তান যাতে আমার অভিনীত চরিত্র "ডাম্পু"র মতো গুণসম্পন্ন হয়। সেদিন আনন্দে কেঁদে ফেলেছিলাম।
১৬) অনুগামীদের উদ্যেশ্যে কী বলতে চাও?
- আমি প্রচন্ড সোজাসাপ্টা কথা বলি তারপরও তোমরা আমায় ভালোবাসো। তোমাদের এই ভালোবাসা পেয়ে সত্যিই আমি কৃতজ্ঞ তোমাদের কাছে। ভুল-ত্রুটি হলে নিজের ঘরের ছেলে ভেবে ক্ষমা করে দিও। নিজের লক্ষ্য স্থির রেখে এগিয়ে যেও।